গ্র্যাজুয়েট এ্যাট্রিবিউটসঃ একটি প্রাথমিক আলোচনা

গ্র্যাজুয়েট এ্যাট্রিবিউটসঃ একটি প্রাথমিক আলোচনা

সপ্তাহ দু’য়েক আগে আমার ‘জব-রেডি গ্র্যাজুয়েটসঃ একটি কেস স্টাডি’ লেখাটি সম্পর্কে অনেকেই বিভিন্ন বিষয়ে আরো জানার জন্য ব্যক্তিগতভাবে ম্যাসেজ পাঠিয়েছেন। সবগুলো বিষয় নিয়ে এক সঙ্গে লেখা সম্ভব নয়। তাই আজকে গ্র্যাজুয়েট এ্যাট্রিবিউটস সম্পর্কে একটা সাধারণ আলোচনা করার চেষ্টা করছি।

‘গ্র্যাজুয়েট এ্যাট্রিবিউটস’ হচ্ছে কোন একটি ডিসিপ্লিনে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করে ছাত্রছাত্রীদের কি ধরনের বিশেষ গুণাবলীর অধিকারী হওয়া উচিত। এক কথায়, এগুলোকে গ্র্যাজুয়েটদের পাঠ অন্তর্ভুক্ত ও পাঠ বহির্ভূত উচ্চমানের কোয়ালিটিস ও স্কীলস বলা যেতে পারে। এইসব কোয়ালিটিস ও স্কীলগুলো তাদের সারাজীবন পারসোনাল ডিভলাপমেন্ট, জীবনে চলার পথে শিক্ষা নিতে আর সমাজ ও কর্মক্ষেত্রে সফলতার সঙ্গে কাজ করতে সহায়তা করে। আসলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষকতাকালীন সময়ে ‘গ্র্যাজুয়েট এ্যাট্রিবিউটস’ সম্পর্কে আমার ধারনা ছিলো খুবই সীমিত। এগুলো সম্পর্কে আমি খুব বিস্তারিত জানতে পারি ইংল্যান্ডে পড়তে যেয়ে।

সব কোর্সেরই মূখ্য লক্ষ্য হলো নিদিষ্ট ডিসিপ্লিনে ছাত্রছাত্রীদের কৌশলগত জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন নিশ্চিত করা। এর সঙ্গে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে সেই বিশেষায়িত জ্ঞান তারা কিভাবে কাজে লাগাবেন তার একটা রূপরেখা দেয়া। একটা ডিসিপ্লিনে গ্র্যাজুয়েটদের এইসব টেকনিক্যাল প্রশিক্ষণ ও জ্ঞানই হচ্ছে হার্ড স্কীলস যা বাংলাদেশে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খুব গুরুত্বের সাথে শেখানো হয়।

কিন্তু এই মূখ্য লক্ষ্যের বাইরে যে কোন কোর্সেরই থাকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। সেটা হলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে অতি প্রয়োজনীয় কিছু সফট্ স্কীলস গড়ে তুলতে সাহায্য করা।

এই সফট্ স্কীলগুলোর মধ্যে আছে কথা বলার ও লেখার উন্নতমানের কমিউনিকেশন স্কীল, স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা ও অন্যের পরামর্শ ও সুপারিশের নৈর্ব্যক্তিক মূল্যায়ন করার ক্ষমতা, প্রবলেম সলভিং স্কীল, নেতৃত্ব দেয়ার ও চাপ সহ্য করার ক্ষমতা, এবং কার্যকর টীমওয়ার্ক স্কীল গড়ে তোলা। উন্নত দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় আরেকটি অত্যাবশ্যকীয় দক্ষতা গড়ে তোলার ওপরে খুব গুরুত্ব দেয়া হয়, সেটা হলো গঠনমূলক সমালোচনা গ্রহণ করার ক্ষমতা।

তবে উন্নত বিশ্বে গ্র্যাজুয়েটরা যেন যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে, তাই তাদের মধ্যে এখন আরো কিছু অত্যাবশ্যকীয় দক্ষতা গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। এগুলো হলো, ইনফরমেশন এ্যন্ড ডিজিটাল লিটারেসি, বিভিন্ন অবস্থান ও কৃষ্টি থেকে আসা মানুষের সঙ্গে সফল মিথষ্ক্রিয়ায় আত্নবিশ্বাসী হবার জন্য কালচারাল কমপিটেন্সি, ইন্টার-ডিসিপ্লিনারি দৃষ্টিভঙ্গি, পরিবেশ সংরক্ষণ মনস্কতা, সমাজের নৈতিক মানদন্ড সম্পর্কে দৃঢ় অবস্হান, যুক্তি আর প্রজ্ঞা দিয়ে পারিপার্শ্বিক সমাজকে প্রভাবিত করার দক্ষতা এবং নিজের আচরণের ফলাফলের দায়দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেয়ার মানসিকতা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি কোর্সেই গ্র্যাজুয়েট কোয়ালিটিস গঠন সম্পর্কে সাধারণত কোর্স ডকুমেন্টে যেসব দিকগুলো উল্লেখ করা হয় সেগুলো হলোঃ
১) কি ধরনের গ্র্যাজুয়েট এ্যট্রিবিউটস ডেভলাপ করার পরিকল্পনা আছে;
২) কি ধরনের কৌশল, পদ্ধতি ব্যবহার করে করবে;
৩) এ্যসেসমেন্টে সেগুলোকে কিভাবে সমন্বয় করা হবে;
৪) প্রশিক্ষকদের মান কেমন হবে আর শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা কি হবে;
৫) সফলভাবে কাজ করতে গিয়ে কি ধরনের রিসোর্সেস প্রয়োজন হবে এবং সেসব কোথা থেকে আসবে;
৬) সত্যিই গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে সেই জ্ঞান ও দক্ষতাগুলো গড়ে উঠেছে কিনা সেটা কি ভাবে জানা যাবে আর
৭) এটা যেহেতু একটা চলমান প্রক্রিয়া তাই ত্রুটি আর সীমাবদ্ধতা সনাক্ত করা গেলে সেগুলো সংশোধনের পন্থা কেমন হবে।

২০০৭ সালে ‘অস্ট্রেলিয়ান ইউনিভার্সিটিস টিচিং কমিটি’ (এইউটিসি) এর অর্থায়নে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে ‘ডিজাইনিং এ ডাইভার্স এ্যন্ড ফিউচার ওরিয়েন্টেড ভিসান ফর আন্ডারগ্র্যাজুয়েট সাইকোলজি ইন অস্ট্রেলিয়া’ নামে একটি প্রকল্পের বাস্তবায়ন হয়। এই প্রকল্পের অনেকগুলো টাস্কফোর্সের মধ্যে একটি ছিলো চার বছর মেয়াদী আন্ডারগ্র্যাজুয়েট সাইকোলজি প্রোগ্রামে কি ধরনের ‘গ্র্যাজুয়েট এ্যট্রিবিউটস’ গড়ে তোলা হবে তার একটা রূপরেখা নির্ধারণ করা।

আন্ডারগ্র্যাজুয়েট সাইকোলজি কোর্সের দেড়-দুই হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মধ্য থেকে কুড়িজন এই টাস্কফোর্সের সদস্য ছিলেন। এই কমিটি চার বছর মেয়াদী আন্ডারগ্র্যাজুয়েট সাইকোলজি প্রোগ্রামে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ছয়টি প্রধান শৈলী (এ্যট্রিবিউটস) গড়ে তোলার প্রস্তাব দেন। চূড়ান্ত রিপোর্টটি প্রকাশিত হয় ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে। অস্ট্রেলিয়ার সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি বিভাগই রিপোর্টটির সব সুপারিশ গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছে।

নীচের লিঙ্ক থেকে রিপোর্টটি ডাউনলোড করা যাবে। আমার মনে হয়, বাংলাদেশে যারা মনোবিজ্ঞান পড়ান, তারা সহজ ভাষায় লিখা এই রিপোর্টটি পড়লে অনেকটা আলোকিত হবেন।
লিঙ্কঃ https://www.psychologycouncil.org.au/…/Grad

উন্নত দেশগুলোতে একক্রেডিটেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষায় প্রতিটা কোর্সের গুণগত মান মূল্যায়ন করা হয়। ‘অস্ট্রেলিয়ান সাইকোলজি একক্রেডিটেশন কাউন্সিল’ (এপিএসি) আমাদের চল্লিশটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিষয়ের প্রায় সাতশ’ কোর্সের মান মূল্যায়ন করে। এসবের বাইরেও আমাদের ক্লিনিক্যাল মাস্টার্স প্রোগ্রামগুলো ‘অস্ট্রেলিয়ান হেলথ প্রাকটিশনার রেগুলেশন এজেন্সি’ দ্বারাও নিয়মিত নিরীক্ষিত হয়।

সারা বিশ্বেই আজকাল উচ্চ শিক্ষা সেক্টরের কমবেশি বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়েছে। শিক্ষা প্রদান করা আসলে এখন আর দশ রকমের সেবা বিক্রয়ের মতোই একটা বাণিজ্যিক ব্যাপার। ছাত্রছাত্রীরা অর্থ লগ্নি করে শিক্ষা কেনেন, তাই তারা এখন আমাদের ক্লাইন্ট। আর সে কারণেই আমরা যারা উচ্চশিক্ষার সাথে জড়িত আছি, তাদের জবাবদিহিতা আর দায়বদ্ধতার ভারও বেড়েছে হাজার গুন। শিক্ষার মান উন্নয়ন আর সেটা ধরে রাখবার প্রতিযোগিতাটাও তাই আজকের যুগে একটা বাস্তবসম্মত ব্যাপার। এদেশে দেখি কিভাবে প্রতিবছরই জাতীয় আর আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কোর্সের সঙ্গে নিজেদের কোর্সের তুলনা করে মান মূল্যায়নের বেঞ্চমার্কিং এক্সারসাইজ চলে।

এই উন্নত প্রযুক্তির যুগে ছাত্রছাত্রীদের হাতে সব তথ্যই পৌঁছে যায় খুব সহজে। বাংলাদেশে ছাত্রছাত্রীদের কাছে এখন বিদেশের সঙ্গে নিজেদের শিক্ষার মানের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করাটা জলের মতই সহজ। তাই মানোন্নয়নের এই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও এখনই এগিয়ে আসতে হবে।

বাংলাদেশে সামনের সারির প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই মনোন্নয়ন প্রচেষ্টায় নিরন্তর কাজ করে চলেছে। তাল মিলিয়ে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের প্রচেষ্টা আরো বেগবান করতে হবে। কয়েক বছর আগে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ‘অস্ট্রেলিয়ান সাইকোলজি একক্রেডিটেশন কাউন্সিল’ (এপিএসি) এর মাধ্যমে তাদের কোর্সগুলোর মান মূল্যায়ন শুরু করেছে। সবার একই লক্ষ্য, প্রতিযোগিতায় টিকতে হবে, আর এই প্রেক্ষিত শুধু নিজের দেশ নয়, দেশ ছাড়িয়ে সমগ্র বিশ্ব।
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা সেক্টরে গ্রস এনরোলমেন্ট রেট (জিইআর) শতকরা ১৬, আর ভারতে ২৭। সেই প্রক্ষিতে, বাংলাদেশে আরো নতুন বিশ্ববিদ্যালয় চালুর যথেষ্ট সুযোগ আছে। তবে উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্রে ‘গ্র্যাজুয়েট এ্যট্টিবিউটস’ আর ‘কম্পিটেন্সি ফ্রেমওয়ার্ক’ নির্ধারণ করার প্রথা চালু হলে আর ইন্ডিপেন্ডেন্ট সংস্থার মাধ্যমে সেগুলোর নিরপেক্ষ মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকলে আমাদের শিক্ষার মানও বাড়বে।

লেখকঃ মীর রবিউল ইসলাম, পিএইচডি (বৃস্টল, ইউকে), পরিবেশ মনোবিজ্ঞানী, সিডনী, অস্ট্রেলিয়া।